RSS

পরীক্ষা – আন্দ্রেই ইয়াখোনতভ



পেনাল্টি স্পটে রাখা ছিল বলটানতুন, হলুদ শিশিরসিক্ত, তাই চকচকে চারপাশে নিখুঁতভাবে ছাঁটা ঘাস আমি ছুটে গিয়ে কিক নিলাম মিটার দুই গিয়ে বলটা আটকে গেল ঘাসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল গোলরক্ষক
পাঁচ বছর ধরে তোমাকে কী শিখিয়েছে?’ পরীক্ষা কমিটির সবাই জিজ্ঞেস করলেন সমস্বরে
আমি, বিষাদগ্রস্ত, মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম
আচ্ছা, এবার তুমি গোলপোস্ট লক্ষ্য করে দৌড় শুরু করো, আমরা তোমাকে পাস দেব,’ বললেন এক পরীক্ষকতুমি চলন্ত অবস্থায় কিক নেবে
আমি দৌড় শুরু করলাম, পাস পেলাম বল, কিন্তু কিক করতে গিয়ে পা পড়ল বলের ওপর আরেকটু হলে পড়েই গিয়েছিলাম
হুম,’ পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলেন পরীক্ষা কমিটির সদস্যরাপাঁচ-পাঁচটা বছর! সোজা কথা নাকি!’
নাকি গোলপোস্টের সামনে লব দেব আর সে হেড দিয়ে গোল করুক?’ প্রস্তাব দিল একজন
না না, সেটার প্রয়োজন নেই তার জন্য এটা খুব দুরূহ হবে,’ বাকিরা বলল সমস্বরে
তাহলে থ্রো করুক সে,’ সবার কথা ছাপিয়ে কার যেন উঁচু কণ্ঠ শোনা গেল
আমি থ্রো করলাম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল সবাই
সর্বনাশ! এক হাত দিয়ে! ঠিক যেন শট থ্রো! সে তো আইনকানুনও জানে না
পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা চেষ্টা করছিলেন পরস্পরের দিকে না তাকাতে
পাঁচ বছরপাঁচ বছরের শিক্ষা…’ দুর্বল কণ্ঠে একজন বললেন, ‘নাকি তাকে ১০০ মিটার দৌড়াতে বলে দেখব?’
সে তো ফুটবলার, দৌড়বিদ নয়
পাঁচ বছরপাঁচ বছর…’ আক্ষেপ শোনা গেল আবার
কমিটির প্রধান সবাইকে শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করলেনহ্যাঁ, পাঁচ বছর তো কম সময় নয় এই পুরো সময় তোমাকে আমরা বড় করেছি, তোমার যত্ন নিয়েছি এসবকে তো বৃথা যেতে দেওয়া যায় না এখন তোমার সময় এসেছে সব পরিশোধ করার
আমি প্রস্তুত কিন্তু কীভাবে?’ প্রশ্ন করলাম আমি
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমিটির প্রধান বললেন, ‘প্রশিক্ষক হবে

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৪, ২০১১

  • Digg
  • Del.icio.us
  • StumbleUpon
  • Reddit
  • RSS

আট কলা – জসীম উদ্দীন



রহিম শেখ বড়ই রাগী মানুষ কোনো কাজে একটু এদিক-ওদিক হইলেই সে তার বউকে ধরিয়া বেদম মারে সেদিন বউ সকালে সকালে উঠিয়া ঘর-দোর ঝাঁট দিতেছে, রহিম ঘুম হইতে উঠিয়া বলিল, ‘আমার হুঁকায় পানি ভরিয়াছ?’ বউ বলিল, ‘তুমি তো ঘুমাইতেছিলে, তাই হুঁকায় পানি ভরি নাই এই এখনই ভরিয়া দিতেছিরহিম চোখ গরম করিয়া বলিল, ‘এত বেলা হইয়াছে, তবু হুঁকায় পানি ভর নাই! দাঁড়াও, দেখাইতেছি তোমায় মজাটাএই বলিয়া সে যখন বউকে মারিতে উঠিয়াছে, বউ বলিল, ‘দেখ, যখন-তখন তুমি আমাকে মার ধর কর, আমি কিছুই বলি না জান, আমরা মেয়ে জাত? আট কলা হেকমত আমাদের মনে মনে ফের যদি মার, তবে আট কলা দেখাইয়া দিব
এই কথা শুনিয়া রহিম শেখের রাগ আরও বাড়িয়া গেল সে একটা লাঠি লইয়া বউকে মারিতে মারিতে বলিল, ‘ওরে শয়তানী, দেখা দেখি তোর আট কলা কেমন? তুই কি ভাবিয়াছিস আমি তোর আট কলাকে ডরাই?’
বহুক্ষণ বউকে মারিয়া রহিম মাঠের কাজ করিতে বাহির হইয়া গেল অনেকক্ষণ কাঁদিয়া কাঁদিয়া বউ মনে মনে একটি মতলব আঁটিল স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া সহজেই মিটিয়া যায় দুপুরে রহিম ভাত খাইতে আসিলে বউ রহিমের কাছে জানিয়া লইল, কাল সে কোন ক্ষেতে হাল বাহিবে বিকাল হইলে বউ বাড়ির কাছের এক জেলেকে ডাকিয়া আনিয়া বলিল, ‘জেলে ভাই! কাল ভোর হওয়ার কিছু আগে তুমি আমাকে একটি তাজা শোল মাছ আনিয়া দিবে আমি তোমাকে এক টাকা আগাম দিলাম আরও যদি লাগে, তাও দিব শেষ রাতে আমি জাগিয়া খিড়কির দরজার সামনে দাঁড়াইয়া থাকিব তখন তুমি গোপনে শোলমাছটি আমাকে দিয়া যাইবে
গ্রামদেশে একটি শোল মাছের দাম বড়জোর আট আনা এক টাকা পাইয়া জেলে মনের খুশিতে বাড়ি ফিরিল সে -পুকুরে জাল ফেলে, -পুকুরে জাল ফেলে কত টেংরা, পুঁটি, পাবদা মাছ জালে আটকায়; কিন্তু শোল মাছ আর আটকায় না রাত যখন শেষ হইয়া আসিয়াছে, তখন সত্য সত্যই একটি শোলমাছ তাহার জালে ধরা পড়িল তাড়াতাড়ি মনের খুশিতে সে মাছটি লইয়া রহিম শেখের বাড়ির খিড়কি-দরজায় আসিল বউ তো আগেই সেখানে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে মাছটি লইয়া বউ তাড়াতাড়ি যে ক্ষেতে রহিম আজ লাঙল বাহিবে, সেখানে পুঁতিয়া রাখিয়া আসিল
সকাল হইলে রহিম ক্ষেতে আসিয়া লাঙল জুড়িল সে এদিক হইতে লাঙলের ফাড়ি দিয়া ওদিকে যায়, ওদিক হইতে এদিকে আসে হঠা তাহার লাঙলের তলা হইতে একটি শোলমাছ লাফাইয়া উঠিল রহিম আশ্চর্য হইয়া মাছটি ধরিয়া লইয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল তারপর বউকে বলিল, ‘লাঙলের তলায় এই তাজা শোল মাছটি পাইলাম খোদার কি কুদরত! এই মাছের কিছুটা ভাজা করিবে, আর কিছুটা তরকারি করিবে অনেক দিন মাছ-ভাত খাই না আজ পেট ভরিয়া মাছ-ভাত খাইব
এই বলিয়া রহিম ক্ষেতের কাজে চলিয়া গেল দুপুর হইতে না হইতেই বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া সে বউ-এর কাছে খাইতে চাহিল বউ একথালা ভাত আর কয়েকটা মরিচ-পোড়া আনিয়া তাহার সামনে ধরিল
একে তো ক্ষুধায় তাহার শরীর জ্বলিতেছে, তাহার ওপর এই মরিচ-পোড়া আর ভাত দেখিয়া রহিমের মাথায় খুন চাপিয়া গেল সে চোখ গরম করিয়া বলিল, ‘সেই শোলমাছ কি করিয়াছিস শীগ্গীর বল?’ বউ যেন আকাশ হইতে পড়িল, এমনি ভাব দেখাইয়া বলিল, ‘কই, মাছ কোথায়? তুমি কি আজ বাজার হইতে মাছ কিনিয়াছ?’
রহিম বলিল, ‘কেন, আমি যে আজ ইটা-ক্ষেত হইতে শোলমাছটা ধরিয়া আনিলামবউ উত্তর করিল, ‘বল কি? ইটা-ক্ষেতে কেহ কখনো শোল মাছ ধরিতে পারে? কখন তুমি আমাকে শোলমাছ আনিয়া দিলে? তোমার কি মাথা খারাপ হইয়াছে?’
তখন রহিমের মাথায় রাগের আগুন জ্বলিতেছে সে চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘ওরে শয়তানী! এমন মাছটা তুই নিজে রাঁধিয়া খাইয়া আমার জন্য রাখিয়াছিস মরিচ-পোড়া আর ভাত! দেখাই তোর মজাটা!’ এই বলিয়া রহিম বউকে বেদম প্রহার করিতে লাগিল বউ চিৎকার করিয়া সমস্ত পাড়ার লোক জড়ো করিয়া ফেলিল, ‘ওরে তোমরা দেখরে, আমার সোয়ামী পাগল হইয়াছে, আমাকে মারিয়া ফেলিল
বউ-এর চিৎকার শুনিয়া -পাড়া -পাড়া হইতে বহু লোক আসিয়া জড়ো হইল তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমরা এত চেঁচামেচি করিতেছ কেন? তোমাদের কি হইয়াছে?’ রহিম বলিল, ‘দেখ ভাই সকলরা! আজ আমি একটা তাজা শোলমাছ ধরিয়া আনিয়া বউকে দিলাম পাক করিতে এই রাক্ষসী সেটা নিজেই খাইয়া ফেলিয়াছে আর আমার জন্য রাখিয়াছে এই মরিচ-পোড়া আর ভাত আপনারাই বিচার করেন এমন বউ-এর কি শাস্তি হইতে পারে?’
বউ তখন হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘দোহাই আপনাদের সকলের আপনারা ভালোমতো পরীক্ষা করিয়া দেখেন আমার সোয়ামীর মাথা খারাপ হইয়া সে যাতাবলিতেছে কিনা? ওর কাছে আপনারা জিজ্ঞাসা করেন, কোথা হইতে মাছ আনিল, আর কখন আনিল?’
রহিম বলিল, ‘আজ সকালে আমি ইটা-ক্ষেতে যখন লাঙল দিতেছিলাম, তখন একটি এত বড় শোলমাছ আমার লাঙলের তলে লাফাইয়া উঠিয়াছিল সেইটি ধরিয়া আনিয়া বউকে রান্না করিতে দিয়াছিলাম
বউ পাড়ার সবাইকে বলিল, ‘আপনারা সবাই বলুন, শুকনা মাঠে তাজা শোলমাছ কেমন করিয়া আসিবে? আমার সোয়ামী পাগল না হইলে এমন কথা বলিতে পারে?’
গাঁয়ের লোকেরা সকলেই বলাবলি করিল, ‘রহিম শেখের ইটা-ক্ষেতের ধারে-পাশে কোনো ইঁদারা-পুকুর নাই সেখানে শোলমাছ আসিবে কোথা হইতে? রহিম নিশ্চয়ই পাগল হইয়াছেতখন তাহারা যুক্তি করিয়া রহিমকে দড়ি দিয়া বাঁধিতে গেল সে যখন বাধা দিতেছিল, সকলে তখন তাহাকে কিল-থাপ্পড় মারিতেছিল একজন বলিল, ‘পানিতে চুবাইলে পাগলের পাগলামি সারে চল ভাই, একে পুকুরে লইয়া গিয়া কিছুটা চুবাইয়া আনিযেই কথা সেই কাজ সকলে ধরিয়া রহিমকে খানিকটা পুকুরে চুবাইয়া আনিল রহিম বাধা দিতে চাহে, কিন্তু কার বাধা কে মানে
রহিম রাগে শোষাইতে লাগিল তখন একজন বলিল, ‘উহাকে আজই পাগলা গারদে লইয়া যাও নতুবা রাগের মাথায় কাকে খুন করিয়া ফেলে বলা যায় না
রহিমের বউ বলিল, ‘আপনারা আজকের মতো ওকে খামের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিয়া যান কাল যদি না সারে, পাগলা গারদে লইয়া যাইবেন
গাঁয়ের লোকেরা তাহাই করিল রহিমকে ঘরের একটি খামের সঙ্গে কষিয়া বাঁধিয়া যে যার বাড়ি চলিয়া গেল
সব লোক চলিয়া গেলে বউ রহিমের হাতে-পায়ের বাঁধন খুলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে মাছ-ভাতের থালা আনিয়া তাহার সামনে ধরিল সদ্য পাক করা মাছের তরকারির গন্ধ সারা দিনের না খাওয়া রহিমের নাকে আসিয়া লাগিল সে মাথা নীচু করিয়া ভাত খাইতে আরম্ভ করিল পাখার বাতাস করিতে করিতে বউ বলিল, ‘দেখ, আমরা মেয়ে-জাত, আট কলা বিদ্যা জানি; তারই এক কলা আজ তোমাকে দেখাইলাম তাতেই এত কাণ্ড! আর বাকি সাত কলা দেখাইলে কি যে হইত বুঝিতেই পার
রহিম বলিল, ‘দোহাই তোমার, আর সাত কলার ভয় দেখাইও না এই আমি কছম কাটিলাম এখন হইতে আর যদি তোমার গায়ে হাত তুলি, তখন যাহা হয় করিও
[গ্রামবাংলার হাসির গল্প থেকে সংগৃহীত]

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৪, ২০১১

  • Digg
  • Del.icio.us
  • StumbleUpon
  • Reddit
  • RSS