দিল্লী থেকে বিশেষজ্ঞ
এসেছেন সুদূর
দীঘাতে কাজু
চাষ পর্যবেক্ষণ
করতে।
বিশেষজ্ঞ মহোদয়
বাঙালি, ইনি
সম্প্রতি মার্কিন
দেশ থেকে
ছয় মাসের
কাজু চাষের
ট্রেনিং নিয়ে
এসেছেন।
আমেরিকায় কাজুর
চাষ হয়
কি না,
সেখানে এর
ট্রেনিং কি
হবে—এ
সব প্রশ্ন
আশা করি
কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন পাঠকেরা দয়া করে
তুলে অসুবিধে
সৃষ্টি করবেন
না।
সে যা হোক,
বিশেষজ্ঞ মহোদয়
সপারিষদ এক
শীতের দুপুরে
দীঘায় গেলেন। এই ঠাণ্ডার দিনেও
খালি গায়ে
রোদ্দুরে বসে
গ্রামের একজন
কৃষক তামাকু
সেবন করছিলেন। হঠাৎ তাঁর
বাড়ির সামনে
সম্ভ্রান্ত লোকজন দেখে তিনি উঠে
দাঁড়ালেন।
তাঁকে দেখে
বিশেষজ্ঞ মহোদয়
বেশ উৎসাহের সঙ্গে
এগিয়ে এলেন,
এসে যে
গাছটায় এতক্ষণ
কৃষক হেলান
দিয়ে বসে
ছিলেন সেটার
গায়ে নিজের
মুখের পাইপটা
ঠুকতে ঠুকতে
জিজ্ঞাসা করলেন,
‘এ গাছটার
গোড়া অক্টোবর
মাসের শেষ
সপ্তাহে নিড়িয়ে,
খুঁড়ে দিয়েছিলেন?’
এই প্রশ্ন শুনে
কৃষক কেমন
থমকে গেলেন। কিছু
বলার আগেই
বিশেষজ্ঞ মহোদয়ের
একজন পারিষদ
বাংলা করে
বুঝিয়ে দিলেন,
‘অক্টোবর, মানে ঐ আশ্বিন মাসে
গাছটার গোড়াটোড়াগুলো
বেশ সাফ
করে দিয়েছিলেন?’
কৃষক এবার বললেন,
‘না।’
শূন্য পাইপটা দাঁত
দিয়ে চিবোতে
চিবোতে বিশেষজ্ঞ
মহোদয় বললেন,
‘তাই বলি,’
তারপর একটু
থেমে আবার
কৃষককে জিজ্ঞাসা
করলেন, ‘গাছটার
ওপরের ডালগুলো
এর মধ্যে
কোনো দিন
ভালো করে
পোকা মারার
ওষুধ দিয়ে
স্প্রে করে
দিয়েছেন?’
কৃষকের মুখ দেখে
বোঝা গেলো
তিনি সাত
জন্মে এ
রকম কিছু
শোনেননি, জেরার
জবাবে থতমত
খেয়ে বললেন,
‘আজ্ঞে, না
তো।’
‘তখনই বলেছিলাম,’ বিশেষজ্ঞ
মহোদয় কাতর
আর্তনাদ করে
উঠলেন, ‘সাধে
এই অবস্থা,’
তারপর অসম্ভব
উত্তেজিত হয়ে
কৃষকের সামনে
দু’ পা
এগিয়ে গিয়ে
প্রায় চেঁচিয়ে
বললেন, ‘আর
কিছু না
করুন, এই
শীতের মধ্যে,
বৃষ্টির আগে
গাছের উপরের
পাতাগুলো একবার
ছেঁটে দেবেন
তো?’
একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির
এ রকম
মারমুখো ভাব
দেখে ইতিমধ্যে
কৃষক রীতিমতো
ঘাবড়িয়ে গেছেন
এবং চার
পা পিছিয়ে
গেছেন।
নিরাপদ দূরত্বে
থেকে তিনি
কোনো রকমে
জবাব দিতে
পারলেন, ‘আজ্ঞে,
না তো।’
মাথায় হাত দিয়ে
বিশেষজ্ঞ মহোদয়
মাটিতে বসে
পড়লেন, ‘এই
ভাবে নিজের
সর্বনাশ করে!
আমি অবাক
হয়ে যাবো
যদি আপনি
এই গাছে
এক কেজির
বেশি কাজু
বাদাম পান।’
একটু দম নিয়ে
কৃষক তাঁর
হাতের হুঁকোতে
দু-তিনবার
জোরে জোরে
টান দিলেন
কিন্তু আগুন
নিবে গেছে,
ধোঁয়া বেরোলো
না, নিরাশ
কণ্ঠে তিনি
বললেন, ‘আমিও
খুব অবাক
হবো।’
এই নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে
বিশেষজ্ঞ মহোদয়ের
মুখে আর
বাক্য জোগালো
না, একজন
পারিষদ তাঁকে
সাহায্য করলেন,
কৃষককে পালটা
জিজ্ঞাসা করলেন,
‘আপনিও অবাক
হবেন?’
এইবার কৃষক বেশ
ধাতস্থ হয়েছেন,
কোমর থেকে
দেশলাই বের
করে হুঁকোটা
ধরিয়ে একমুখ
ধোঁয়া ছেড়ে
বললেন, ‘অবাক
হবো না?
এটা হলো
শ্যাওড়া গাছ,
এই শ্যাওড়ায়
এক কেজি
কেন, যদি
একটা কাজু
বাদামও হয়
নিশ্চয়ই অবাক
হবো, খুবই
অবাক হবো।’
উপরের গল্পটি সম্পূর্ণ
বানানো।
এর সঙ্গে
কোনো জীবিত
ব্যক্তি বা
প্রকৃত ঘটনার
কোনো সংযোগ
নেই।
বরং বিশেষজ্ঞ সম্পর্কে
সেই সাঁতারের
শিক্ষকের গল্পটি
একবার স্মরণ
করি।
গল্পটি বাংলা
ভাষায় অনবদ্য
ভঙ্গিতে লিখেছিলেন
শিবরাম চক্রবর্তী,
মূল ইংরেজিটা
বোধহয় পি
জি ওডহাউসের,
নাকি স্টেফান
লীককের।
গল্পটা রীতিমতো চওড়া,
অন্ততঃ শিবরাম
চক্রবর্তীর কলমে। বিস্তারিত বর্ণনা
থাক, আসল
ঘটনা এই
রকম।
সাঁতারের বিখ্যাত
ইস্কুলের সাঁতার
শিক্ষকেরও খুব খ্যাতি। তিনি
শিক্ষার্থীদের নানা রকম নির্দেশ দেন,
তাঁরই নির্দেশে
কতজন যে
দক্ষ সাঁতারুতে
পরিণত হয়েছে,
অতি আনাড়ি
অবস্থা থেকে,
তার হিসাব
নেই।
একদিন হঠাৎ জলে
পড়ে গেলেন
শিক্ষক মশায়। তিনি
তীর থেকে
নির্দেশ দিতেন
কিন্তু সেদিন
কি করে
পাড় থেকে
জলে পড়ে
গেলেন।
তারপর নাকানি-চুবানি খেয়ে
ডুবে মরেন
আর কি!
সেদিনই প্রকাশ
পেলো তিনি
সাঁতার একদম
জানেন না,
জীবনে কখনো
জলে নেমেছেন
কিনা তাই
সন্দেহ।
অবশ্য এতে
অবাক হওয়ার
কিছু নেই। সাঁতার
শেখাতে গেলে
সাঁতার জানতেই
হবে এমন
কোনো কথা
নেই।
আমার নিজের উদাহরণ
দিয়ে বলতে
পারি।
আমি গানের
গ জানি
না।
গান সম্পর্কে
আমার সুরজ্ঞান
এবং কণ্ঠস্বর
দুইই ভয়াবহ। বিশুদ্ধ
ব্রাহ্মণের কাছে গো-মাংস যেরকম,
আমার কাছে
সারেগামাও তাই। একটা উদাহরণ
দিয়ে বোঝাতে
পারি।
একবার এক
অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজছিল, বাজনা শুনে
আমি বুঝতে
পারলাম ‘ধনধান্যে
পুষ্পেভরা’—দ্বিজেন্দ্রলালের জাতীয় সঙ্গীতটি বাজানো
হচ্ছে, আমি
জাতীয় সঙ্গীতের
প্রতি যথারীতি
সম্মান প্রদর্শনের
জন্যে উঠে
দাঁড়ালাম।
আমি ছিলাম সেই
সভায় প্রধান
অতিথি বা
বিশেষ অতিথি
বা ঐ
রকম কিছু। পাশেই
সভাপতি মহোদয়
বসে ছিলেন। তিনি
আমাকে উঠে
দাঁড়াতে দেখে
বললেন, ‘উঠছেন
কেন?’ আমি
বললাম, ‘আপনিও
দয়া করে
উঠুন।
দেখছেন না
জাতীয় সঙ্গীত
বাজছে।’
সভাপতি মহোদয়ের
দুই চোখ
কপালে উঠলো। বেশ
চমকিত হয়ে
জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কাম সেপ্টেম্বর
আবার কবে
থেকে জাতীয়
সঙ্গীত হলো?’
আমি আর
কিছু বললাম
না, ঝুপ
করে চেয়ারে
বসে পড়লাম।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই
সভাটি ছিলো
একটি সঙ্গীত
বিদ্যায়তনের বার্ষিক উৎসব এবং
আমাকে বড়ো
সমঝদার ভেবে
কর্তৃপক্ষ অতিথি করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কর্তৃপক্ষের তেমন দোষ
দেওয়া চলে
না।
এ রকম
ভুল সর্বত্রই
হয়।
যাঁকে আমরা
কোনো বিষয়ে
অথরিটি বলে
ধরে নিয়েছি
তিনি হয়তো
সেই বিষয়ে
একজন প্রকৃত
হস্তিমূর্খ। দশচক্রে যে রকম
ভগবান ভূত
হয় তেমনি
মূর্খও পণ্ডিত
বলে খ্যাত
হয়।
তবে ঐ
দশচক্রের মূল
চক্রটি উচ্চাভিলাষী
মূর্খ নিজেই
আবর্তন করান।
অজ্ঞদের গালাগাল করা
রুচিসম্মত নয়, বিশেষজ্ঞের কথা হচ্ছিলো
সেই কথাই
বলি।
ইংরেজিতে বলা
হয় কোনো
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের আরো-আরো-আরো
জানতে জানতে
অবশেষে এভরিথিং
অফ নাথিং
জানাই হলো
বিশেষজ্ঞের বা পণ্ডিত শ্রেষ্ঠের স্বপ্ন। এই নাথিং কিন্তু
ঠিক নাথিং
নয়, দু-একটা উদাহরণ
দিচ্ছি।
মনে করুন
একজনের বিষয়
হলো মৌর্য
যুগের স্বর্ণমুদ্রার
সিংহের ডান
পায়ের (সামনের)
মধ্যমার দৈর্ঘ্য। ইনি
কিন্তু এ
বিষয়ে এখন
পর্যন্ত দশ
হাজার পৃষ্ঠা
লিখে ফেলেছেন। ইনি
ইতিহাসের লোক। এঁরই
বন্ধু সাহিত্যের,
তাঁর বিষয়
হলো শিলাইদহের
কুঠিবাড়ির মধ্যের ঘরের বড় শাল
কাঠের জলচৌকিটির
পায়ার কাছে
যে কালির
দাগ লেগে
ছিল সেই
মসিচিহ্ন কি
শিলাইদহ বোটে
জলচৌকিটি নিয়ে
সোনার তরী
কবিতাটি লেখার
সময়, (যদি
নেওয়া হয়ে
থাকে), দোয়াত
উলটে লেগে
গিয়েছিল? এই
বক্তব্যের পক্ষে এবং বিপক্ষে তিনি
একশো রকম
তথ্য ও
সাক্ষ্য সংগ্রহ
করেছেন।
আজ কিছুদিন হলো
শরীরটা ভালো
যাচ্ছে না,
ডাক্তার সাহেবের
হাতে আছি। বিশেষজ্ঞ
নিয়ে লেখা
শেষ করার
আগে তাঁদের
সম্পর্কে কিছু
না লেখা
অনুচিত হবে।
আমাদের ছোটবেলায় পারিবারিক
ডাক্তার পায়ের
গোড়ালি থেকে
মস্তকের ব্রহ্মতালু
পর্যন্ত সর্বাঙ্গের
চিকিৎসা
করতেন।
তিনিই বহু
পরে একবার
কানে ব্যথা
হওয়ায় বললেন
ই-এন-টি স্পেশালিস্টের
কাছে অর্থাৎ নাসিকা-কর্ণ-কণ্ঠ
বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে। এর অনেকদিন পরে
একবার মিনিবাসে
একটা লোক
আমার নাকটা
গুঁতিয়ে দিলো,
রীতিমতো ফুলে
গেলো।
সেই ই-এন-টির
কাছে গেলে
তিনি বললেন,
‘আমি এখন
শুধু কান
করছি।
আপনি ডঃ
নাগের কাছে
যান।
তিনি এখন
নাক করেন।’ ডঃ
নাগকে গিয়ে
দেখালাম।
তারপর এই
গত সপ্তাহে
ঠাণ্ডা লেগে
ভীষণ মাথা
ভার; একটা
নাক, ডান
নাকটা সম্পূর্ণ
বন্ধ।
আবার গেলাম
ডঃ নাগের
কাছে।
তিনি সব
দেখে বললেন,
‘ডান নাক
আমার দ্বারা
হবে না,
আমি এখন
শুধু বাঁ
নাক দেখছি।’
তারাপদ রায়:লেখক। জন্ম:
১৭ নভেম্বর
১৯৩৬, মৃত্যু:
২৫ আগস্ট
২০০৭।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
** All Jokes Collected From Various Source